চোল রাজবংশ

  • চোলরা ছিল দক্ষিণ ভারতের এক অতি প্রাচীন জাতি।
  • মহাভারত, অশোকের শিলালিপি, গ্রিক ঐতিহাসিকদের বিবরণে চোলদের উল্লেখ পাওয়া যায়।
  • চোল রাজা হিসেবে কারিকলের নাম পাওয়া যায়।
  • আনুমানিক দ্বিতীয় শতকে কারিকল বর্তমান কালের পেনার ও ভেলার নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে (তাঞ্জোর, ত্রিচিনোপল্লী, পদুকোটাই প্রভৃতি অঞ্চলে) চোল শাসন শুরু করেন। কিন্তু চের, পল্লব, পাণ্ড্যদের ক্রমাগত আক্রমণের জন্য এক শতকের মধ্যেই চোল রাজ্যের পতন ঘটে।
  • খ্রীষ্টীয় নবম শতক থেকে চোল শক্তির পুনরুত্থান ঘটে। প্রায় তিনশো বছর ধরে চোলরা দক্ষিণ ভারতে আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল।

রাজা বিজয়ালয় (৮৫০ - ৮৭১ খ্রিষ্টাব্দ):

  • খ্রীষ্টীয় নবম শতকে পল্লব এবং পান্ড্য রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে পল্লবদের এক সামন্ত রাজা বিজয়ালয় -এর নেতৃত্বে চোল শক্তির পুনরুত্থান ঘটে।
  • বিজয়ালয় পাণ্ড্যদের হারিয়ে তাঞ্জোর অধিকার করেন এবং তাঁর সময়কাল থেকে চোলদের রাজধানী হয় তাঞ্জোর।

প্রথম আদিত্য ( ৮৮০ - ৯০৭ খ্রিস্টাব্দ ) :

  • বিজয়ালয়ের পর তাঁর পুত্র প্রথম আদিত্য চোল সিংহাসনে বসেন।
  • আদিত্য চোল পল্লব-রাজ অপরাজিত বর্মনকে শ্রীপুরামবিয়ামের যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করে চোল শক্তির স্বাধীনতা ও সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন।
  • তিনি কঙ্গু প্রদেশ জয় করেন এবং গঙ্গদের পরাজিত করেন।
  • তাঁর আমলে চোল রাজ্য উত্তরে মাদ্রাজ থেকে দক্ষিণে কাবেরী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।

প্রথম পরান্তক (৯০৭ - ৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ) :

  • প্রথম আদিত্যের পর চোল রাজা হন তাঁর পুত্র প্রথম পরান্তক।
  • তিনি পাণ্ড্য রাজা জয়সিংহকে পরাজিত করে পাণ্ড্য জয় করেন।
  • তিনি নেলোর পর্যন্ত চোল রাজ্যের বিস্তার করেন।
  • চোল শক্তির বিস্তারে আতঙ্কিত হয়ে রাষ্ট্রকূট রাজা তৃতীয় কৃষ্ণ বাণ ও গঙ্গ রাজার সঙ্গে একত্রিত হয়ে চোল রাজ্য আক্রমণ করে। এই আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য পরান্তক তাঁর পুত্র রাজাদিত্যকে পাঠান। কিন্তু তৃতীয় কৃষ্ণ রাজাদিত্যকে তাক্কোলামের যুদ্ধে’ (৯৪৯ খ্রিঃ) পরাজিত করে নিহত করেন।
  • এরপর প্রথম পরান্তকের মৃত্যু হয়। এরফলে কিছুদিনের জন্য চোল শক্তি দূর্বল হয়ে পড়ে।

প্রথম রাজরাজ (৯৮৫-১০১৩ খ্রিস্টাব্দ):

  • সুন্দর চোলের পুত্র প্রথম রাজরাজ -এর নেতৃত্বে ৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে চোলরা আবার শক্তিশালী হয়ে ওঠে। প্রথম রাজরাজ ছিলেন চোল বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক।
  • তাঁর সামরিক কৃতিত্বের কাহিনীর উল্লেখ পাওয়া যায় তাঞ্জোর লিপিতে।
  • তিনি সবার প্রথম ত্রিবান্দ্রমের কাছে চেরদের পরাজিত করেন। এরপর তিনি পাণ্ড্যদের পরাজিত করে মাদুরা দখল করেন এবং পাণ্ড্যরাজ অমরভুজঙ্গকে বন্দী করেন।
  • তিনি চালুক্যদের পরাজিত করে বেঙ্গী দখল করেন।
  • বিশাল নৌবাহিনীর সাহায্যে কেরল আক্রমণ করেন এবং কেরলের রাজা রবিবর্মাকে ত্রিবান্দ্রমের নৌযুদ্ধে পরাজিত করেন।
  • এরপর তিনি ভারতের মূল ভূখণ্ড ছাড়িয়ে সিংহল আক্রমণ করেন। সিংহলের রাজা পঞ্চম মহেন্দ্র প্রথম রাজরাজের বশ্যতা স্বীকার করেন ।এরপর অনুরাধাপুরে চোল অধিকৃত সিংহলের রাজধানী স্থাপন করেন।
  • তিনি নৌ-অভিযান চালিয়ে লাক্ষাদ্বীপ ও মালদ্বীপ অধিকার করেন।
  • তাঞ্জোরের বিখ্যাত রাজরাজেশ্বর মন্দির তাঁরই কীর্তি।
  • রাজরাজ ছিলেন শৈব ধর্মের উপাসক। পরধর্মমতসহিষ্ণুতা ও ছিলো তাঁর চরিত্রের অন্যতম গুন।

প্রথম রাজেন্দ্র চোল(১০১৪-১০৪৪ খ্রিস্টাব্দ) :

  • প্রথম রাজরাজের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র প্রথম রাজেন্দ্র চোলদের সিংহাসনে বসেন। তিনি ছিলেন চোল বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা।
  • তিনি 'গঙ্গাইকোন্ডচোল' ও 'উত্তমচোল' নামে পরিচিত ছিলেন।
  • ‘তিরুমালাই পর্বতলিপি’ও ‘তাঞ্জোরলিপি’ থেকে রাজেন্দ্র চোলের পরিচয় পাওয়া যায়।
  • বিরাট নৌবাহিনী নিয়ে তিনি সিংহল আক্রমণ করে সিংহলকে চোল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন।
  • ১০১৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি পাণ্ড্য ও চের (কেরল) রাজ্য দুটিকে পরাজিত করে চোলদের অধীনে নিয়ে আসেন এবং নিজের পুত্রকে ঐ রাজ্যগুলির শাসনকর্তা রূপে নিযুক্ত করেন।
  • চালুক্যদের পরাজিত করে তিনি হায়দ্রাবাদে চোলদের আধিপত্য বিস্তার করেন।
  • তিনি কলিঙ্গের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয়ে বাংলাদেশ আক্রমণ করেন। তিনি পূর্ববঙ্গের শাসক গোবিন্দচন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মহীপাল এবং দক্ষিণবঙ্গের রণসূরকে পরাজিত করেন। পূর্ব ভারত জয়লাভ করে তিনি 'গঙ্গাইকোন্ডচোল' (গঙ্গা-বিজেতা চোল) উপাধি ধারণ করেন।
  • বাংলাদেশ থেকে ফিরে তিনি কাবেরী নদীর তীরে গঙ্গাইকোন্ড চোলপুরম নামে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। ১৬ মাইল লম্বা ‘চোলগঙ্গ হদ’ খনন করেন।
  • শক্তিশালী নৌবাহিনীর সাহায্যে তিনি আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং মালব জয় করেন।
  • রাজেন্দ্র চোলের নৌবাহিনীর আধিপত্যে বঙ্গোপসাগর ‘চোল হ্রদে’ পরিণত হয়েছিল।
  • রাজেন্দ্র চোলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কীর্তি হল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সুমাত্রার শৈলেন্দ্র বংশের বিরুদ্ধে নৌ-অভিযান। শৈলেন্দ্র সাম্রাজ্য শ্রীবিজয় নামেও পরিচিত ছিল। শৈলেন্দ্র বংশের রাজা বিজয় তুঙ্গবর্মন রাজেন্দ্র চোলের কাছে পরাজিত হন। এই পরাজয় ফলে শৈলেন্দ্র সাম্রাজ্যের কিছু অংশ চোলদের দখলে আসে।
  • ১০৪৪ খ্রিস্টাব্দে চালুক্যদের সঙ্গে যুদ্ধে তাঁর মৃত্যু ঘটে।

রাজাধিরাজ (১০৪৪-১০৫২ খ্রিস্টাব্দ):

  • রাজেন্দ্র চোলের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র প্রথম রাজাধিরাজ চোল সাম্রাজ্যের রাজা হন।
  • তিনি চের ও পাণ্ড্যদের দমন করতে সক্ষম হন।
  • তিনি সিংহলের বিরুদ্ধেও অভিযান করেন।

বীর রাজেন্দ্র (১০৬৪-১০৭০ খ্রিস্টাব্দ):

  • চোলদের পরবর্তী উল্লেখযোগ্য রাজা ছিলেন বীর রাজেন্দ্র ।
  • তিনি চালুক্যদের আক্রমণ প্রতিহত করে চোল সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষা করেন।
  • চালুক্যদের বিরুদ্ধে জয়ের স্মৃতিস্বরূপ তিনি তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরে একটি বিজয়স্তম্ভ নির্মাণ করেন।

কুলোতুঙ্গ (১০৭০-১১২০ খ্রিস্টাব্দ):

  • পরবর্তী চোল রাজা ছিলেন কুলোতুঙ্গ ।
  • চালুক্য সম্রাট ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য তাঁকে পরাজিত করে বেঙ্গী অধিকার করেন।
  • যদিও তাঁর সময়কালে চোলদের সঙ্গে চালুক্যদের সংঘর্ষ কিছুটা কমেছিল। এর অন্যতম কারণ ছিল তাঁর স্ত্রী ছিলেন একজন চালুক্য রাজকন্যা।
  • তৃতীয় রাজাধিরাজের সময়ে (১২০৬-১২৫৬ খ্রিস্টাব্দ) পাণ্ড্যরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং তাঞ্জোর আক্রমণ করে।
  • দীর্ঘ দিন ধরে চোল ও চালুক্য দের মধ্যে সংঘর্ষ অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ এবং পান্ড, হোয়সেল, কাকতীয় প্রভৃতি শক্তির আক্রমণে চোল রা হীনবল হয়ে পড়ে।

কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা

  • বিভিন্ন চোল রাজাদের শিলালিপি — বিশেষ করে প্রথম পরান্তকের লিপি, রাজরাজের তাম্রশাস, সমসাময়িক মুদ্রা এবং বিভিন্ন চৈনিক ও আরব গ্রন্থকারদের রচনা থেকে চোল শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে জানা যায়।
  • প্রাচীন ভারতে চোলরা একটি সুষ্ঠ, সুদক্ষ ও সুবিন্যস্ত শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়। তাঁরা সামন্ত দের প্রভাব খর্ব করে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হন। রাজা বা রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রজার সরাসরি যোগাযোগ ছিল।
  • রাজা সর্বেসর্বা ছিলেন এবং রাজপদ ছিলো বংশানুক্রমিক। রাজা সর্ব শক্তির আধার হলেও কখনোই স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না। তাঁকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য একটি কর্মচারী পরিষদ ছিলো।
  • সমগ্র চোল রাজ্যকে বলা হতো ‘ চোলমন্ডলম ‘।
  • চোল রাজ্য দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল:- (ক) সামন্ত শাসিত অঞ্চল - যেখানে সামন্তরাজারা কর দিতেন ও যুদ্ধকালে রাজাকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতেন (খ) চোল রাজার প্রত্যক্ষ শাসনাধীন অঞ্চল।রাজার প্রত্যক্ষ শাসনাধীন অঞ্চল কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। প্রদেশ গুলিকে বলা হতো ‘মণ্ডলম’।প্রদেশ বা মন্ডলম গুলি কয়েকটি ‘কোট্টাম ‘ বা জেলায় বিভক্ত ছিল। কোট্টাম গুলি নাড়ু বা অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। নাড়ুর অধীনে ছিল ‘কুররম ‘ বা কিছু সংখ্যক গ্রামের সমষ্টি বা গ্রাম সমবায়।
  • সাধারণত রাজপুত্ররাই মন্ডল এর শাসনকার্য পরিচালনা করতো। তাই তাদের বলা হতো মণ্ডলেশ্বর।
  • ভূমি রাজস্ব ছিলো সরকারী আয়ের প্রধান উৎস। এই কর নগদ অর্থে বা উৎপাদিত শস্যের এক তৃতীয়াংশ থেকে এক পঞ্চমাংশ এর মধ্যে ওঠানামা করতো।
  • বিচারের কাজ স্থানীয় ভাবেই পরিচালিত হতো। গ্রামের বিচার চলতো পঞ্চায়েতের মাধ্যমে। রাজকীয় আদালতকে বলা হতো ‘ধর্মাসন’। দেওয়ানী ও ফৌজদারি মামলার বিচার একই স্থানে হতো। রাজা নিজে রাজদ্রোহের বিচার করতেন।
  • চোল দের একটি সুসংগঠিত সেনাবাহিনী ছিলো এবং এর প্রধান ছিলেন রাজা। সেনাবাহিনী চারটি ভাগে বিভক্ত ছিল…. পদাতিক, অশ্বারোহী বাহিনী, হস্তি বাহিনী এবং নৌ বাহিনী। একটি চোল শিলালিপি থেকে জানা যায় যে ৭০ টি ‘রেজিমেন্ট ‘ নিয়ে চোল বাহিনী গঠিত ছিলো। চোল দের সমগ্র সৈন্য সংখ্যা ছিলো ১ লক্ষ ৫০ হাজার। তাদের হস্তি বাহিনীর সংখ্যা ছিল ৬০ হাজার। রাজা ও রাজপুত্ররা যুদ্ধক্ষেত্রে সেনা পরিচালনা করতেন।
  • চোল শাসন ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন ব্যবস্থা। প্রত্যেক গ্রামে একটি করে নির্বাচিত সাধারণ সভা থাকতো। এই সভার সদস্যরা গ্রাম শাসন পরিচালনা করতেন। সাধারণ সভা ছিলো দুই ধরেনের:- (১) উর এবং (২) সভা বা মহাসভা। গ্রামের সকল প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষই উর-এর সদস্য ছিলেন। ব্রাহ্মণদের বসবাসকারী গ্রামের সমিতিকে বলা হতো সভা বা মহাসভা।
  • স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পের ক্ষেত্রে এই যুগ এক গুরুত্ত্বপূর্ণ অধ্যায়। রাজপ্রাসাদ গুলি ছিলো পঞ্চ বা সপ্ততল বিশিষ্ট। এই যুগে মন্দির স্থাপত্যের বিকাশ ঘটে। চোল স্থাপত্য রীতি ‘দ্রাবিড় স্থাপত্য রীতি’ নামে পরিচিত। এই যুগের মন্দিরগুলি ছিলো পাঁচ বা ছয় তলা বিশিষ্ট। মন্দিরের দেওয়ালে থাকতো বিরাট বিরাট তোরণ যা গোপুরম নামে পরিচিত। এই যুগের মন্দিরগুলির মধ্যে তাঞ্জরের বৃহদীশ্বর মন্দির, কাঞ্চিপুরমের কৈলাস নাথের মন্দির এবং গঙ্গইকোণ্ড চোলপুরমের মন্দির উল্লেখযোগ্য। মন্দির গুলির দেওয়ালে খোদাই করা বিভিন্ন মূর্তি ও কারুকার্য চোল ভাস্কর্যের বিশিষ্ট উদাহরণ। রাজরাজের নির্মিত তাঞ্জোরের রাজরাজেশ্বর শিব মন্দিরটি (১০০৩ --১০১০ খ্রীঃ) ছিল চোল শিল্পকলার উৎকৃষ্ট নিদর্শন। তাঞ্জোরের মন্দিরে নির্মিত ব্রোঞ্জের নটরাজ মূর্তি চোল আমলের ধাতুশিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। অজন্তা ও এলিফ্যান্টার কয়েকটি গুহামন্দির চোল আমলে নির্মিত হয়েছিল।